জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা চাই, ভারত যেন শান্তিতে থাকে। আমরা এ–ও চাই, তারা যেন আমাদের অশান্তির কারণ না হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে তারা সীমা অতিক্রম করে ফেলে। বাংলাদেশের মসনদে কে বসবে, কে সরকার গঠন করবে, তারা বাংলাদেশে এসে তরকারিতে লবণ দেয়। বাংলাদেশের মানুষ ঠিক করবে, কে ক্ষমতায় আসবে, কে আসবে না।’

আজ সোমবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড় মাঠে জামায়াতের এক কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের–বিপক্ষের অনেক বিভক্তির কথা, অনেক বিষ ছড়ানোর কথা আমরা শুনেছি। যাঁরা এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন করতে চাই। এবারের মহান বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন এটাকে ভারতের বিজয় দিবস দাবি করে টুইট করেছেন, সেখানে একটা শব্দও বাংলাদেশ নাম উচ্চারণ করেননি, তখন আপনাদের চেতনা কোথায় ছিল? এটা যদি বাংলাদেশের বিজয় হয় আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁদের বিজয় হিসেবে দাবি করেন, তাহলে আপনারা চুপ কেন? তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় যায়? সীমান্তে যখন ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকে, তখন চেতনা কোথায় থাকে? দিনের পর দিন এ দেশের নিরীহ মানুষকে সীমান্তে হত্যা করা হয়, তখন তো আপনাদের মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। আমরা প্রতিবেশী দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে চাই। আশা করব, তারাও আমাদের দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।’

জামায়াতের আমির বলেন, ‘এই দেশ বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষের। যুগ যুগ ধরে এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছি। কিন্তু যে দলটি (আওয়ামী লীগ) জাতিকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে রেখেছিল, সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু বলে, তারা ফায়দা লুটেছে। দেশে সংখ্যালঘু বলে যদি কিছু থাকে, তবে এই দলই করেছে। দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া, হায়েনার মতো এই কাজগুলো তারাই করেছে।’

জামায়াতের আমির আরও বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়, তা তদন্তের জন্য ২০১৩ সালে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনকে চিঠি দিয়েছিলাম। এই তদন্ত করবে জাতিসংঘ। আমরা সহযোগিতা করব। আমরা চাই, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত, এমনকি আজকের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে যা অঘটন ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। সেই প্রতিবেদন জাতির সামনে প্রকাশ করা হোক। সেই প্রতিবেদনে আমি যদি দুষ্কৃতকারী বলে চিহ্নিত হই, তবে আমাকেও যেন ক্ষমা করা না হয়। আমরা দেখতে চাই, কারা এই জাতির সর্বনাশ করে।’

যদি মসজিদ পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তবে মন্দিরও পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না—এমন মন্তব্য করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর চার দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া, এ দেশে বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। কারণ, দেশের মানুষ দেশকে ভালোবাসে। এই দেশের প্রত্যেক মানুষ ছিল এ দেশের সরকার। জামায়াতে ইসলামী, অন্যান্য ইসলামি দল, মাদ্রাসার ছাত্র ও অন্য দেশপ্রেমী সেই চার দিন মন্দির, মঠ, প্যাগোডা, চার্চ পাহারা দিয়েছেন। দুর্গাপূজা যখন এল, একটা গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা শুরু করল। আমরা হিন্দুধর্মের ভাইদের আশ্বস্ত করে বললাম, “আপনাদের পাশে থেকে আমরা পাহারা দেব।” তাঁরা তাঁদের পূজা করেছেন, আমরা তাঁদের সহযোগিতা করেছি। আমরা চাই না, নির্দিষ্ট একটি ধর্মাবলম্বীর উৎসব আসবে, আর তাঁদের পাহারা দেওয়া লাগবে। যদি মসজিদ পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তবে মন্দিরও পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা সেই সামাজিক বলয় দেখতে চাই।’

শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছে, জুলুম করা হয়েছে, দেশের স্বার্থে এসব যন্ত্রণা বুকে চেপে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। আমরা চাই না এ দেশ আর বিভক্ত হোক। আমরা চাই, ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাত একত্র হোক। সবাই হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে একসঙ্গে এগিয়ে যাব। তবে এটা ঠিক, যাঁরা খুন করেছেন, গুম করেছেন, লুণ্ঠন করেছেন, চুরি করে ২৬ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তাঁদের বিচার হতে হবে। আর ওই টাকা দেশে ফেরত আনতে হবে। এগুলো জনগণের টাকা।’

শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘বিপুল জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে জনসংখ্যা কোনো অভিশাপ নয়। জনসংখ্যাকে আমরা শক্তিতে পরিণত করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ১৮ কোটি মানুষের হাতকে যদি কর্মীর হাতে পরিণত করতে পারতাম, সবার হাতে যদি কাজ তুলে দিতে পারতাম, তাহলে এই দেশের চেহারা বদলে যেত। এ দেশের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সে দেশের চেহারা বদলে দিচ্ছেন। কিন্তু আফসোস, নিজেদের দেশের চেহারাটাই আমরা বদলাতে পারলাম না। নির্যাতন, জুলুম, খুন-গুম, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের তাণ্ডব চালানোর সাড়ে ১৭ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারছে।’

এই বাংলাদেশ গঠনে আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে জানিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, ‘মানবতার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চলবে। আমরা বৈষম্যহীন দেশ চাই, চাঁদাবাজমুক্ত দেশ চাই, দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই, অবৈধ দখলদারমুক্ত দেশ চাই, ঘুষমুক্ত দেশ চাই, একটা সাম্যের মানবিক বাংলাদেশ চাই। সেই বাংলাদেশের জন্য আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাব।’

কর্মী সম্মেলনে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম, ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন, জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুল হাকিম, জেলা জামায়াতের আমির বেলাল উদ্দীন প্রধানসহ জেলা ও উপজেলা জামায়াতের নেতারা বক্তব্য দেন।