আপনি পরিবারের প্রধান কর্তা। পুরো পরিবারের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও নিত্য আয়-ব্যয় দেখভাল করেন। আপনার তিন ছেলেই আয় করে। এর মধ্যে বড়জনের তুলনায় তৃতীয়জনের আয় বেশ ভালো। ধরুন, বড় ছেলের চাকরি চলে গেছে বা বেতন একদম কমে গেছে। এখন পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আপনি কার কাছে টাকা চাইবেন? বড় ছেলের কাছ থেকে, না যে বেশি আয় করে, সেই ছেলের কাছে?
পারিবারিক এই দৃশ্যপটকে একটু ক্রিকেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন তো। পরিবারের কর্তা হিসেবে আইসিসি আর তিন ছেলে হিসেবে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিকে ভাবতে থাকুন। বিলক্ষণ দেখতে পাবেন, পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য কম আয়ের বড় ছেলেরূপী টেস্টকে নয়, বেশি আয়ের ছোট ছেলে টি-টোয়েন্টিকেই আপনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট দলের কোচ শুকরি কনরাডের মূল কথাও কিন্তু এমনই ছিল। এ বছরের জানুয়ারির ঘটনা। নিউজিল্যান্ড সফরের টেস্ট দল ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড (সিএসএ) তখন ব্যাপক সমালোচিত।
তখন পর্যন্ত অভিষেক হয়নি, অধিনায়কসহ এমন সাতজনকে রেখে দল ঘোষণা করায় চারদিকে ব্যাপক হইচই। টেস্টের জন্য অমন দল পাঠানোর কারণ ছিল এসএ-টোয়েন্টির জন্য ৭১ জন প্রথম সারির ক্রিকেটারকে ধরে রাখা। ওই সময় বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হতে থাকে ‘টেস্ট ক্রিকেটকে অসম্মান করা হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের এই সিরিজ খেলাই উচিত নয়’ ধরনের নানা কথা। সাবেক অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ তো টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যু পরোয়ানাও দেখে ফেলেন তাতে।
ওই সময় দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট দলের কোচ কনরাড আত্মপক্ষ সমর্থনের এক পর্যায়ে বলে বসেন, ‘টি-টোয়েন্টি লিগ না হলে টেস্টও থাকবে না।’ তাঁর যুক্তিটা ছিল, দিন শেষে খেলাটা টাকার সঙ্গেই জড়িত। আর টি-টোয়েন্টিতে যেহেতু টাকার প্রবাহ বেশি, টেস্ট বাঁচাতে টি-টোয়েন্টিরই দ্বারস্থ হতে হবে।
টেস্ট ক্রিকেটের বেঁচে থাকাটা যে টি-টোয়েন্টির ওপর নির্ভরশীল, এ ধরনের একটি মন্তব্য আছে সৌরভ গাঙ্গুলীরও। ২০১৮ সালে ভারতের সাবেক অধিনায়ককে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বেশি বেশি ম্যাচ খেলতে গিয়ে ক্রিকেটাররা টেস্ট ক্রিকেটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কি না, এতে ক্রিকেটের স্বার্থে হিতে বিপরীত হচ্ছে কি না? সৌরভ জবাব দিয়েছিলেন, ‘টি-টোয়েন্টি লাগবে। তাহলেই ক্রিকেট বাঁচবে।’
মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া–ভারত বক্সিং ডে টেস্টের প্রথম দিনে দর্শক ছিল প্রায় ৯০ হাজার। কিন্তু অন্য দেশগুলোয় এত দর্শক সচরাচর দেখা যায় নাএএফপি
কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটকে বেঁচে থাকতে হলে বর্তমান বাস্তবতায় টেস্ট থেকে টাকা আসতে হবে। আজীবন ছোট ভাইয়ের ওপর ভর করে চলা টেকসই ব্যাপার নয়। আর টেস্ট থেকে টাকা আনতে হলে এই ক্রিকেটে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটি যে হচ্ছে না, তা তো গত কয়েক বছরের চিত্রই বলে দিচ্ছে।
এমনকি ভবিষ্যতে দর্শক আগ্রহ বাড়ার আভাসও জোরালো নয়। গ্যালারি, টিভি, মোবাইল অ্যাপ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাজ’ তৈরির মাধ্যমে বছর বছর ক্রিকেট–দুনিয়ায় যেসব অনুসারী যোগ হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই টি-টোয়েন্টির ভোক্তা। মনোযোগ আর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে চার-ছক্কার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। কিছু ক্ষেত্রে ওয়ানডেও। কিন্তু টেস্টের প্রতি আগ্রহী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে বলে দৃশ্যমান প্রমাণ নেই।